আপনি ঠিক আছেন তো?

0

অজয় দাশগুপ্ত: সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখে অষ্ট্রেলিয়ায় একটি অভিনব দিবস পালিত হয়ে গেল। আমি ঠিক জানি না দুনিয়ার আর কোনো দেশ বা সমাজে এইরকম দিন পালনের সংস্কৃতি আছে কি না? দিবসটির নাম ‘আর ইউ ওকে?’ এর বাংলা তর্জমা হওয়া উচিৎ, আপনি ঠিক আছেন তো? সম্পর্কভেদে এটা তুই, তুমিকেও সেভাবে বলা যেতে পারে। কেন এমন দিবস? ওরা বলছে, এর ভেতর দিয়ে এমন একটা বিশ্ব গড়ে তোলা যেখানে সকলেই সকলের সাথে যুক্ত থাকবেন এবং এই নিবিড় আত্মীয়তা বা সৌজন্য মানুষকে আত্মহননের পথ থেকে মুক্ত রাখবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অষ্ট্রেলিয়ার মতো ধনী, স্বচ্ছল এবং উন্নত দেশে প্রতিদিন গড়ে আটজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেন। পরিসংখ্যান এটাও বলছে, প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেন?

বিশ্লেষণে যাবার আগে আসুন একবার বাংলাদেশের দিকে তাকাই। আপনি কি জানেন, করোনাকালে গেল এক বছরে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে প্রায় ১৪ হাজার নারী-পুরুষ? পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট— এসব আত্মহত্যার ঘটনার মূল কারণ। খেয়াল করুন এই কারণগুলোর সাথে দৃশ্যত করোনাভাইরাসের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব মানুষ জীবন বিসর্জন দিয়েছেন স্বেচ্ছায়। বাধ্য হয়েছেন এই সুন্দর পৃথিবীকে বিদায় জানাতে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ হতাশ হলে নিতান্ত ঠুনকো কারণেও নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তখন নিজেকে বড্ড একা মনে করে এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আপাতদৃষ্টিতে, অন্যদের কাছে কারণটি অগুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও বিষাদগ্রস্থ ব্যক্তির জন্য ওই মুহূর্তে ওই কারণটিই অনেক বড় হয়ে সামনে আসে।

ধনী-গরীব বা মধ্যবিত্ত এখানে ব্যাপার না। নানা কারণে মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। শিল্প সংস্কৃতিতেও এর প্রভাব দেখেছি আমরা। শ্রুতি আছে, কবি জীবনানন্দ দাশ আত্মহননের জন্য ট্রামের মতো শ্লথ গতির যান বেছে নিয়েছিলেন। এমন কাজ তিনি একা করেননি, বাংলা গানের সেরা গীতিকারদের একজন পুলক বাবুও জীবন দিয়েছিলেন নিজের মতো করে।

আত্মত্যাগ ও আত্মহত্যা কিন্তু এক বিষয় না। বহু মানুষ দেশ, সমাজ বা জনগণের জন্য নিজের জীবন দান করে শহীদ হন। তাদের কথা আলাদা। যাদের কথা বলছি তাদের একজন মুনিয়া নামের মেয়েটি। বিষয়টি এখনো স্পষ্ট না, তবে এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে সে আত্মহত্যা করেছিল। তার বোন বিচার চেয়ে বলেছে, মুনিয়া নাকি গর্ভবতী ছিল সে সময়। তাই যদি হয় তো কী করার ছিল তার? তখন যদি তার পাশে কেউ থাকত বা তাকে অভয় দিত কিংবা তাকে মনিটর করত তরুণীটি হয়তো জানে বেঁচে যেত।

ফিরে আসি অস্ট্রেলিয়ার আলাপে। এই ‘আর ইউ ওকে’র শুরুটিও হয়েছে বেদনা দিয়ে। এর শুরু হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার এক ল্যার্কিন ফ্যামিলি থেকে। পরিবারের কর্তা ব্যারি ল্যার্কিনকে তার পরিবার ও বন্ধুরা যে পছন্দ করত না তা কিন্তু নয়। কিন্তু একদিন সবাইকে অবাক ও বিস্মিত করে তিনি আত্মহত্যা করলেন। কেউ ভেবে পেল না কী এমন হয়েছিল যে তাকে জীবন দিতে হলো। বহুবছর পর ২০০৯ সালে তার ছেলে গ্যাভিন ল্যার্কিন উপলব্ধি করলেন তার পিতাকে কেউ কখনও বলেনি, আর ইউ ওকে? শুধু এটুকু বলা বা তার খোঁজ-খবর নেয়াটাই জরুরী ছিল। পরবর্তীতে একটি ডকুমেন্টারিতে তিনি কথাটি তুলে ধরেন। সারা দেশে ছড়িয়ে দেবার জন্য একটি ছক তৈরি করেন। সেই থেকেই এই দিবসের সৃষ্টি।

মনে রাখতে হবে যে দেশ যত উন্নত, যে সমাজে যত প্রতিযোগিতা সেখানে মানুষ ততটাই আত্মকেন্দ্রিক। এরকম আত্মকেন্দ্রিক মানুষে ভরা শহর কলকাতা। সেখানে আত্মহননের হার ভয়াবহ। ঢাকাও কিন্তু খুব পিছিয়ে নেই। অথচ আমাদের দেশ বা সমাজে মানুষ অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার মতো বিচ্ছিন্ন নয়। এখনো ঘরে ঘরে তরকারি-মিষ্টি বিনিময় বহাল রয়েছে। গাঁ-গেরামে তো সবাই সবার সাথে ঘনিষ্ঠ। তবে ঢাকার মতো বড় শহরে তা তেমন সুখকর কিছু নয়। তবু এক ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয় বলে অন্যসব দেশের তুলনায় মানুষ একে অপরের সাথে বেশি জড়িয়ে।

অন্যদিকে টাকা-পয়সা, সমাজ নিরাপত্তা, পরিবেশ ও খাদ্যে উন্নত দেশগুলোর মানুষ মূলত একা। এখানে এমন লোকজনও আছেন যারা স্বামী-স্ত্রী ছাড়া কেউ কাউকে চেনেন না। ব্যাংকে কাজ করার সময় এক মহিলা এসেছিলেন ব্যাংক চেক কিনতে। কথা বলে জানলাম, তার স্বামী মারা গেছেন, কেউ নাই আর তার। তিনি এই চেক জমা দিলে দাফন কোম্পানি সব ঠিক করে দেবে। কেউ নাই? এ নিয়ে কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলার চোখ ছলছল করছিল। আহা! বেদনা, সেই ভদ্রলোকের কেউ বেঁচে নাই আর। বহুবছর আগে অন্য এক দেশ থেকে এসেছিলেন তারা। ধীরে ধীরে সব ঘনিষ্ঠজনেরা চলে যাবার পর তাদের আর কেউ ছিল না এখানে। এ কাহিনী শোনার পর আমার দুচোখ বেয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল তা দেখে ভদ্রমহিলা বলেছিলেন, এই যে তুমি তৃতীয়জন যে তার জন্য কাঁদলে। এমনই বিষণ্ন একা সমাজ এখানকার। এখানে এমন একটা ‘আর ইউ ওকে?’ দিবস আসলে দরকারই।

কিন্তু আজকের বাংলাদেশের অবস্থাও কি তেমন না? মানুষে মানুষে আজ না আছে ভালোবাসা, না আছে কোনো আন্তরিকতা? বড় বড় শহরে মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব যোজন যোজন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জগত খোলার পর মানুষ কবে কার মুখ ভালো করে দেখেছে জানেই না। মা-বাবা, সন্তানদের ভেতরও এখন বিস্তর দূরত্ব। ডিজিটাল জগতে হাই-হ্যালো কিংবা আই লাভ ইউ-এর তোড়ে আসল ভালোবাসা পালিয়েছে জানালা খুলে। না কেউ কারো হাতে হাত রাখে, না কাঁধে। আলিঙ্গনের মতো বিষয়টাও আজ আর চলে না। এই বাস্তবতায় মানুষ মানুষের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

একবার চিন্তা করেন তো, কবে কখন কোথায় আপনি কাউকে চোখে চোখ রেখে জানতে চেয়েছেন সে বা তিনি আসলে কেমন আছেন? কে খবর রাখে আমাদের অন্তরের? মেকি সভ্যতা আমাদের জোর করে হাসতে-কাঁদতে, আহা-উহু করতে শিখিয়েছে বটে, তবে কেড়ে নিয়েছে আবেগ। এই কঠিন সময়ে ‘আর ইউ ওকে?’ বা ‘আপনি কেমন আছেন?’ এটা জানতে চাওয়া এক ধরনের ঔষধই বৈকি। এর নাম সহমর্মিতা, এর নাম ভালোবাসা।

কেন এই দিবসটি আমরা পালন করি না? অন্তত একটা দিন বা এই দিনের কারণে অন্যান্য দিনও আমরা কি আমাদের কাছের বা দূরের মানুষদের কাছে জানতে চাইতে পারি না– আসলেই কেমন আছেন তারা? তাদের অন্তর বা মন কি ভালো আছে? তারা কি আমাদের কাঁধে বা আমরা কি তাদের বাহুতে মুখ রেখে একটু কেঁদে হালকা হতে পারি না?

এই ‘আর ইউ ওকে?’ যদি একজন মানুষের প্রাণ বাঁচায় তো এর ব্যবহারে কি অসুবিধা? কেউ কি ভেবে দেখবেন? একবার হলেও জানতে চাইবেন কেমন আছি আমরা সবাই?

সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here