ঢাকা নগরীতে ২৫ ‘হিট আইল্যান্ড’

0

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: গরমের মধ্যে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ঢাকায় তাপপ্রবাহের ফলে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ২৫টি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে এক গবেষণায়। এই এলাকাগুলোর নাম গবেষকরা দিয়েছেন ‘হিট আইল্যান্ড’।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেড ক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর যৌথভাবে ঢাকা শহরের তাপদাহ নিয়ে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অন হিট ওয়েভ ইন ঢাকা’ শীর্ষক একই গবেষণা চালায়। গত সেপ্টেম্বরেই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সহকারী পরিচালক ও ফোরকাস্ট বেইজড অ্যাকশনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ শাহজাহান সাজু বলেন, এজন্য জিআইএস সফটঅয়্যার ব্যবহার করে ঢাকায় ‘হিট আইল্যান্ড’ বের করার চেষ্টা করেছেন তারা।

“এ গবেষণা পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকায় করা হয়েছে। ঢাকায় তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতার মধ্যে মহানগরের ‘হিট আইল্যান্ড’গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।”

ঢাকার হিট আইল্যান্ডগুলো

বাড্ডা, গুলশান, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, গোড়ান, বাসাবো, টঙ্গী, শহীদনগর, বাবুবাজার, পোস্তগোলা, জুরাইন, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কুর্মিটোলা, আজমপুর, উত্তরা, কামারপাড়া, মোহাম্মদিয়া হাউজিং, আদাবর, ফার্মগেইট, তেজকুনিপাড়া, নাখালপাড়া, মহাখালী।

দুই কোটি মানুষের বাস ঢাকা নগরীতে তাপপ্রবাহের প্রবণতা বাড়িয়ে তুলেছে ঘনবসতিপূর্ণ বসবাস, বড় বড় দালান, প্রচুর গাড়ি, অনেক কারখানা।

অসহনীয় গরমে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকায় হিট ওয়েভ বা তাপপ্রবাহের প্রবণতা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘হিট আইল্যান্ড’গুলোতে গড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ এসব এলাকায় গরম তখন তাপপ্রবাহের পর্যায়ে চলে যায়।

পরপর তিন দিন ও বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে উচ্চ তাপমাত্রা থাকলে তবেই তাকে বলে তাপপ্রবাহ। থার্মোমিটারের পারদ চড়তে চড়তে যদি ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে, আবহাওয়াবিদরা তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলেন। উষ্ণতা বেড়ে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে বলা হয় মাঝারি তাপপ্রবাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ ধরা হয়।

শাহজাহান সাজু বলেন, “সাধারণত ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা রিজনেবল, এর উপরে গেলে অসহনীয় হয়ে পড়ে। ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ডিগ্রি হলে ‘আর্লি অ্যাকশনস’ নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছি আমরা।”

আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ড. আব্দুল মান্নান বলেন, সারা পৃথিবীতে তাপমাত্রা বাড়ছে, বাংলাদেশ অংশেও বাড়ছে। এ কারণে ‘হিট ওয়েভের কন্ডিশন’ও বাড়ছে।

তার মতে, ঢাকা শহরে হিট ওয়েভের প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে কিছু কিছু এলাকা, যেখানে হিট ওয়েভ সহনশীলতার বাইরে চলে যাবে। যেখানে উঁচু ভবন, কারখানা রয়েছে কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।

মান্নান বলেন, “খুলনা, বরিশাল এবং রাজশাহী- এসব সিটি এলাকাগুলোও আস্তে আস্তে হিট ওয়েভ কন্ডিশনের জন্য ক্রমাগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।”

শাহজাহান সাজু বলেন, “এ বছর পাইলটিং করেছি। এখন আরও বড় পরিসরে করা দরকার। এ জন্য পরিকল্পনা রয়েছে।”

গরম কখন কেমন

>> গত ২৪ এপ্রিল যশোরে এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৩৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

>> এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধে দেশের অধিকাংশ এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ছিল।

>> এপ্রিল মাসে নেত্রকোনা, মদন, খালিয়াজুড়ি, কেন্দুয়া, কিশোরগঞ্জের নিকলী, করিমগঞ্জ, সদর এলাকাসহ বিস্তীর্ণ জনপদে বয়ে যায় ‘হিটশক’।

>> মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোরে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় ছিল ৩৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

>> ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। একই বছর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও ৪০ ডিগ্রিতে উঠেছিল।

>> গত দুই যুগে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠেছিল যশোরে। তার আগে ১৯৯৫ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠেছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

>> স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে রেকর্ড ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছিল।

তাপপ্রবাহ বাড়ছে, বিস্তৃতও হচ্ছে

আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, এপ্রিল-জুলাই মাসে ‘হিট ওয়েভ’ ঘটে বেশি। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও এ ধরনের প্রবণতা হয়ে থাকে।

এবার সেপ্টেম্বরের শেষেও উত্তরাঞ্চলে অনেক জায়গায় তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।

মান্নান বলেন, “আমরা বজ্রপাতের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়তে দেখছি সাম্প্রতিককালে, এর সঙ্গে হিট ওয়েবও প্রবণতা দেখছি। গত দু’বছরে জুলাই মাসে দেখেছি বেশ। টাইম-স্পেস চেঞ্জ হচ্ছে … গত কয়েক বছরে প্রি-মুনসুন পিরিয়ডে হিট ওয়েব অতটা ডমিনেট করেনি। এ বছর বিশেষ করে মার্চ থেকে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মে পর্যন্ত বেশ কয়েকটি হিট ওয়েভ হয়েছিল। এর মধ্যে চারটি ছিল খুবই স্ট্রং, লম্বা পিরিয়ড ধরে।

ঢাকাসহ দেশের বড় নগরীগুলোর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ধীরে ধীরে ‘হিট ওয়েব’ প্রবণ হয়ে উঠছে বলে জানান তিনি।

মান্নান বলেন, “চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী- এসব সিটি এলাকাগুলো আস্তে আস্তে ক্রমাগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। যেসব জায়গায় তাপপ্রবাহ হত না, তার মধ্যে ছিল সিলেট। প্রচুর বৃষ্টিপাত, স্থানীয় আবহাওয়াগত কারণে সাধারণত হিট ওয়েব দেখা যেত না। একটা এনালাইসিসে দেখলাম, সিলেট অঞ্চলে হিট ওয়েবের প্রবণতা প্রতিবছরই বাড়ছে। এ বছরও যে হিট ওয়েবগুলো হয়েছিল, সবগুলোরই বর্ধিতাংশ সিলেট পর্যন্ত ছিল। আগে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রকট ছিল না। এ বছর শুধু সীতাকুণ্ডই নয়, রাঙামাটি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; ৩৯.৩ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠেছে।”

ঝুঁকিতে যারা, তাদের জন্য চাই সহায়তা

এতদিন না ভাবলেও তাপপ্রবাহের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার সময় এখন হয়েছে বলে মনে করেন আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান।

তিনি বলেন, “ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে সতর্ক করতে হবে। সালাইন, পানীয়, ওষুধ সরবরাহ ও প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তার বিষয়টি রয়েছে।”

‘হিট ওয়েভ’ আবহাওয়াগত ঘটনা হলেও বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে এটা ক্রমেই বাড়ছে। এ বছর কানাডায় তাপপ্রবাহে বহু মানুষ মারা গেছে।

তাপপ্রবাহে অনেকের নানা ধরনের অসুবিধা হয়, বিশেষ সমস্যায় পড়ে কর্মহীন হয়ে পড়ে খেটেখাওয়া ও দিনমজুররা। বয়স্কদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে; অনেকের ডায়রিয়া হয়, খাদ্যাভাব ও পুষ্টির অপ্রতুলতায় বিভিন্ন রকমের অসুস্থতা দেখা দেয়।

মান্নান বলেন, “এমন আন-ইউজুয়াল ফেনোমেনা, হিট ওয়েবে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, হিট ওয়েভের পূর্বাভাস লাগবে; সেই সঙ্গে যারা ঝুঁকিপূর্ণ, তাদের জন্য সহায়তা লাগবে।”

গবেষণার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সহকারী পরিচালক শাহজাহান বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। অনেকে বুঝতে পারছে না, কী কারণে এ শহর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন ধরনের রোগ হচ্ছে মানুষের, অনেক সময় হিট স্ট্রোক হচ্ছে, এর জন্যে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে, তা নিয়ে সচেতন করা দরকার।”

সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here