বিএমইটিতে টাকার খেলা

0

মো. আশরাফুল ইসলাম:

উন্নত জীবনের খোঁজে সৌদি আরব যেতে চান মনির (প্রকৃত নাম নয়)। মাস দেড়েক আগে যোগাযোগ করেন রাজধানীর কাকরাইলের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে। মনিরকে জানানো হয়, এক মাসের মধ্যেই তাঁকে সৌদিতে পাঠানোর বন্দোবস্ত হয়ে যাবে, তবে টাকা লাগবে স্বাভাবিক খরচের চেয়ে এক লাখ বেশি। সৌদিতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই চাকরির নিশ্চয়তা, সঙ্গে যাবতীয় খরচ বহনের অঙ্গীকার করে এজেন্সি। এ জন্য এজেন্সিকে দিতে হবে চার লাখ টাকা। চাকরিও লোভনীয়। মাসিক বেতন দেড় হাজার রিয়াল বা প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব সৌদি আরবের হোটেল মালিকের।

লোভনীয় প্রস্তাব! রিক্রুটিং এজেন্সিকে সব টাকা দিয়ে দিন গুনতে থাকেন মনির। নির্ধারিত সময়ে এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, আরো এক লাখ টাকা লাগবে। অন্যথায় জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র বা স্মার্টকার্ড বের করতে বিলম্ব হবে। চার লাখ টাকা জোগাড় করতেই বেচতে হয়েছিল গ্রামের জমি। তার পরও সুদে ঋণ এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করতে হয়েছিল। এখন কোথায় পাবেন আরো এক লাখ টাকা? শেষাবধি বিএমইটিতে যান নিজের স্মার্টকার্ডের খোঁজে। কিন্তু এজেন্সি ছাড়া কারোর স্মার্টকার্ডের খোঁজ নেওয়ার সুযোগই নেই। মনিরের সৌদি আরব যাওয়ার স্বপ্ন তাই অধরাই রয়ে গেল।

শুধু মনির নন, তাঁর মতো অনেকেই রিক্রুটিং এজেন্সির লোভনীয় ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। আবার অনেকে বিদেশে গিয়ে চুক্তি অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না, কাজ পেলে বেতন পাচ্ছেন না। অবর্ণনীয় কষ্ট সইতে না পেরে অনেকে আবার খালি হাতে দেশেও ফিরে আসছেন। কেউ কেউ পালিয়ে চলে যাচ্ছেন অন্য দেশে। এই যাওয়ার পথে অনেকে সীমান্তে ধরা পড়ে জেল খাটছেন, কেউ বা পড়ছেন অপহরণকারীদের খপ্পরে। তখন তাঁদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় মুক্তিপণ জোগাড়ের।

নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশে শ্রমিকদের যাওয়ার ক্ষেত্রে বিএমইটি থেকে একটি স্মার্টকার্ড নিতে হয়। ভিসা, চাকরির চুক্তিপত্র, কজের দক্ষতার সার্টিফিকেট, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সার্টিফিকেট যাচাই থেকে শুরু করে সব কাগজপত্র সঠিকভাবে নিরীক্ষা করেই তারপর দেওয়ার কথা স্মার্টকার্ড বা ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স। তাদের অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোই যাত্রী সংগ্রহ করে তাঁদের বিদেশে যাওয়ার সব কাজ সম্পন্ন করে।

ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, আসলেই কি তা করা হয় সরকারি এই কার্যালয়ে? এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী সেল। দুদিনের নিরবচ্ছিন্ন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বিএমইটি কার্যালয়ের ভেতরের আসল চিত্র। অফিসে বহির্গমন শাখায় যেখান থেকে যাবতীয় তথ্য যাচাই করে স্মার্টকার্ড দেওয়ার কথা, সেটি যেন অনৈতিক লেনদেনের স্বর্গ।

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, টাকার বিনিময়ে কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সই ব্যবস্থা করে ফেলছেন এজেন্সির লোকজন। তারপর তাঁরা কাগজপত্রের ফাইল নিয়ে চলে যাচ্ছেন স্মার্টকার্ড প্রিন্টিং শাখায়। সেখানেও টাকার খেলা। কার্ড তাড়াতাড়ি প্রিন্ট করানোর জন্যও হাতে গুঁজে দিচ্ছেন টাকা। অথচ এখানে সরকারি চালানের মাধ্যমে ও ব্যাংক ড্রাফট ছাড়া কোনো লেনদেন হওয়ার কথা নয়। আর এভাবেই যাত্রীদের বহির্গমনের ছাড়পত্র প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

কথা হয় রিক্রুটিং এজেন্সির এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, বিএমইটির প্রতিটি ইটকে টাকা দিতে হয়। বেশি হলে লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিয়ে। এমনকি বিএমইটির মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী-পিয়নকে পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। আরেকজন বলেন, বড় টাকার অ্যামাউন্ট আগের দিন রাতে সেটেল হয়ে যায়। পরের দিন শুধু কাগজপত্র নিয়ে গেলেই চলে। টাকার পরিমাণ নির্ধারণ হয় এক দিনে কতজন লোকের স্মার্টকার্ড করা হবে তার ওপর। একজন তো বলেই ফেলেন, ‘টাকা তো দিতেই হবে, সরকারি অফিসে কি টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয়?’

এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম উল্টো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যারা এক দিনেই কাগজপত্র যাচাই করে স্মার্টকার্ড দিতে পারে। একমাত্র বিএমইটিই এটা করতে পারে। এখানে সেবাগ্রহীতার চেয়ে সেবাদাতার কষ্ট বেশি। কিন্তু এক দিনে কিভাবে একজন যাত্রীর সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ‘সময় তো লাগেই। যেমন—কাতারের একটা ভিসা যাচাই করতে হবে। এখন কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভিসা কনফার্ম হতে দুই থেকে তিন দিন তো লেগেই যায়’।

তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এক দিনে ঠিকই স্মার্টকার্ড প্রিন্ট হচ্ছে, এতে যাচাই-বাছাইয়ের বালাই নেই। বহির্গমন ছাড়পত্র পাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে টাকার ওপর।

অবশ্য আশার কথাও শোনালেন বিএমইটির মহাপরিচালক। তিনি জানান, তাঁরা একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম করার চিন্তা করছেন, যেখানে যাত্রীর সব কাগজপত্র রিক্রুটিং এজেন্টরা আপলোড করে দেবে, সঙ্গে কাগজপত্র যাচাই করার লিংক দেবে। তাহলে সঠিকভাবে কাগজপত্র যাচাই করে করা যাবে। স্মার্টকার্ড প্রিন্ট করে ডেলিভারি করার একটা তারিখ দেওয়া থাকবে। শুধু সেদিন রিক্রুটিং এজেন্সির লোক এসে কার্ড নিয়ে যাবে। এতে বিএমইটির এসব অনৈতিক লেনদেন বন্ধ করা যাবে, কারণ যত মানুষ কম আসবে তত দুর্নীতি কম হবে।

সূত্র: কালের কন্ঠ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here